বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন—বিশেষত ২০২৪ সালে দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের পতন—দেশে উদারনৈতিক রাজনীতির বহুস্তরীয় সংকটকে নতুনভাবে দৃশ্যমান করেছে। গত দশকে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, প্রশাসনিক ব্যক্তিকরণ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনৈতিক দখলদারি উদারনীতিকে কার্যত প্রান্তিক করে তুলেছিল। কিন্তু ২০২৪–পরবর্তী পরিস্থিতি কেবল একটি বিদ্যমান সংকটকেই পৃষ্ঠে তুলেনি; বরং দেখিয়েছে যে বাংলাদেশের উদারনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামো বহু বছর ধরে যেসব বিরোধ, বৈপরীত্য ও দুর্বলতা বহন করে এসেছে—সেগুলোর সম্মিলিত ফলাফলের মধ্যেই আজকের এই রাজনৈতিক বাস্তবতা গড়ে উঠেছে। ফলে এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো—উদারনীতির ঐতিহাসিক শিকড়, প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্যুতি, বাম রাজনীতির পতন, ইসলামি রাজনীতির উত্থান, তরুণদের পরিচয় সংকট এবং ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের পথ—এসবকে একটি বিশ্লেষণমূলক কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করা।
উদারনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারাবাহিকতা, যার ভিত্তি গঠিত হয় ব্যক্তিক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ এবং আইনের শাসনের ওপর। বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের প্রারম্ভেই এই আদর্শ প্রাসঙ্গিক ছিল। পাকিস্তান আমলে বাঙালির আত্মপরিচয়বোধ, ভাষাগত ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামই ছিল উদারনৈতিক রাজনীতির প্রথম ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী উত্থান, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক রাষ্ট্রচিন্তার প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট ছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান—ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ—এই চারটি নীতির মাধ্যমে—রাষ্ট্রকে এক আধুনিক উদারনৈতিক কাঠামোয় স্থাপন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক ভাঙন, ক্ষমতার জন্য অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা এবং পরবর্তীকালে সামরিক শাসনের সূচনা—উদারনীতিকে বাস্তব রাজনীতির বাইরে সরিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে।
বাংলাদেশের উদারনীতির পতনের অন্যতম বড় কারণ হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনগত এবং নৈতিক সীমাবদ্ধতা। আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে লিবারেল-ন্যাশনালিস্ট আদর্শের ধারক হিসেবে পরিচিত হলেও, তাদের দীর্ঘমেয়াদি শাসনকালে রাষ্ট্রযন্ত্রের দলীয় ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থাকে। বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় উদারনৈতিক মূল্যবোধ কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাকস্বাধীনতার সংকোচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইন, বিরোধী দল দমনে প্রশাসনিক শক্তির ব্যবহার—এসবই উদারনীতির সাংবিধানিক কাঠামোর বিপরীত। ফলে আওয়ামী লীগ লিবারেল জাতীয়তাবাদের একটি তাত্ত্বিক শক্তি হিসেবে পরিচিত থাকলেও বাস্তবে ক্রমে এমন একটি দল হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে, যাদের রাজনৈতিক আচরণ উদারনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অপরদিকে বিএনপি নিজেদের মধ্যপন্থী ও গণতান্ত্রিক ধারার দল বলে দাবি করলেও তারা উদারনৈতিক রাজনীতির সাংগঠনিক ও মূল্যবোধগত ভিত্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। দলীয় নেতৃত্বের অনিশ্চয়তা, জামায়াতের উপর নির্ভরতা, বৈরিতাপূর্ণ রাজনীতি এবং অতীতের দুর্নীতির চিত্র তাদের উদারনৈতিক বিকল্প হয়ে উঠার পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল প্রায়শই প্রতিক্রিয়াশীল, অবস্থানহীন ও ধারাবাহিক স্বচ্ছতার অভাবে দুর্বল হয়েছে। ফলে জনগণের চোখে তারা একটি কার্যকর উদারনৈতিক শক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
বাংলাদেশে উদারনীতির অবক্ষয়ে বাম রাজনীতির পতন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীনতার আগে বামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমিক অধিকার, শিক্ষিত যুবসমাজের রাজনৈতিক চেতনায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা তিনটি স্তরে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়—আদর্শগত কঠোরতা, সাংগঠনিক অস্থিতি এবং বাস্তব রাজনীতি থেকে দূরত্ব। বামপন্থীরা তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতার ওপর অতিরিক্ত জোর দিয়ে জনমানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ প্রগতিশীল রাজনীতির একটি বড় ধারা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং উদারনৈতিক মূল্যবোধের জন্য একটি বিকল্প নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে।
২০২৪–এর পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে—তা পূরণে উদারনৈতিক শক্তি ব্যর্থ হলেও ইসলামি রাজনৈতিক গ্রুপগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজেদের পুনর্গঠন করছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপ্রত্যাশিত জয় দেখায় যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক হতাশা কতটা গভীর। ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের সহিংসতা, র্যাগিং, দখলদারি এবং ছাত্রদলের ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তা এমন অবস্থার জন্ম দিয়েছে যেখানে শিবিরকে একটি প্রতিবাদী বিকল্প হিসেবে দেখা হয়েছে। শিবিরের জয় আদর্শিক নয়—তা মূলত উদারনৈতিক ও মধ্যপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতার ফলাফল। ছাত্রসমাজ বাস্তবে এমন এক শক্তির সন্ধান করেছে, যারা অন্তত বর্তমান ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি করবে না।
NCP–এর উত্থান বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে নতুন আশা তৈরি করেছিল। আধুনিক, মধ্যপন্থী, নাগরিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু তাদের আদর্শিক অস্পষ্টতা, ধর্মভিত্তিক সংগঠনের প্রতি নরম অবস্থান, জাতীয় ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর অবস্থান এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক অবস্থানের অভাব—তাদের উদারনৈতিক বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে। লিবারেল রাজনীতি স্বচ্ছতা ও নৈতিক দৃঢ়তা দাবি করে; NCP সেসব ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকায় তারা উদারনৈতিক শক্তির শূন্যতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশে তরুণরা বর্তমানে এমন এক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশে অবস্থান করছে, যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত দুর্বলতা, চরম বেকারত্ব, মানসিক হতাশা এবং পরিচয়বোধের সংকট তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া এবং আঞ্চলিকভাবে ভারতের হিন্দুত্ব রাজনীতির উত্থান তরুণদের পরিচয়বোধকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে। রাষ্ট্র একটি বহুত্ববাদী পরিচয়ের ধারণা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রযুক্তি-প্রভাবিত প্রজন্মের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এই পরিচয় সংকটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিকল্প ‘নৈতিক কাঠামো’ হিসেবে উপস্থাপন করছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান উদারনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপদ তৈরি করছে। রাষ্ট্র যখন একটি একক ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন নাগরিক অধিকার, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা, নারী অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখায় যে ডানপন্থী ও ধর্মীয় রাজনীতি রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ওপরও চাপ তৈরি করছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সামাজিক মেরুকরণ, রাষ্ট্র-নির্ভর দমননীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে একটি নতুন উদারনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রথমে নিজেদের অতীতের ভুল স্বীকার করে দলীয় গণতন্ত্র পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নৈতিক নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছ প্রশাসনিক আচরণ এবং মানবাধিকারের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতি ছাড়া উদারনীতির পুনর্জন্ম সম্ভব নয়। তরুণ প্রজন্মের বাস্তব ইস্যু—কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষানীতি, জলবায়ু সংকট, মানসিক স্বাস্থ্য—এসবকে কেন্দ্র করে একটি সমসাময়িক উদারনৈতিক রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখায় যে উদারনীতি রাষ্ট্রের কাঠামোতে যতই দুর্বল হোক—এর বিকল্প নেই। একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে হলে উদারনীতির পুনর্নির্মাণ এখন সময়ের দাবী। অতএব, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাহসী সিদ্ধান্ত, নৈতিক দৃঢ়তা এবং জনমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ উদারনীতির সংকট অতিক্রম করতে পারে। রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যতই অগ্রসর হোক—উদারনীতির পুনর্গঠনই এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সক্ষম হবে।
Comments