২০২৪ সালের আগস্টের ৮ তারিখ—প্রায় তিন দিনব্যাপী অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার পর শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে “দীর্ঘ জুলাই”-এর অবসান ঘটে। এরপর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করলে বলা যায়, সরকার মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে দেশকে স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে বিষয়ভিত্তিক ও ব্যাখ্যা-নির্ভর।
অধ্যাপক ইউনুস ও তাঁর উপদেষ্টারা শুরু থেকেই সরকারের দুটি প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন:
১. জুলাই হত্যাকাণ্ড ও আগের শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার, এবং
২. দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, যার ফলাফল হবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
এর সঙ্গে আরও দুটি অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল: রাষ্ট্রের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিশ্চিত করা।
নিচে এই চারটি লক্ষ্য অনুযায়ী সরকারের কর্মদক্ষতা বিশ্লেষণ করা হলো।
১. দৈনন্দিন প্রশাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনা
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এত কঠিন পরিস্থিতি থেকে কাজ শুরু করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পালিয়ে গেছেন, জাতীয় মসজিদের ইমাম দেশত্যাগ করেছেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত বিলুপ্ত—এমন ভয়াবহ প্রশাসনিক ভাঙন থেকে এই সরকার যাত্রা শুরু করেছে। তবু, দেশ অরাজকতায় নিমজ্জিত হয়নি। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের আশঙ্কা ছিল, তাঁর পতনের পর প্রতিশোধে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হবে—কিন্তু তা হয়নি। এ দিক থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম সাফল্য ছিল নৈরাজ্য ঠেকানো ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও সরকারের দুর্বলতম দিক। সেনাবাহিনীকে টানা দশ মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যা সরকারের অক্ষমতার প্রতীকও বটে। জর্জিয়ার মতো সাহসীভাবে পুলিশ পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি; আবার ইরাকের মতো বিপর্যয়ও দেখা দেয়নি। তাই বলা যায়, এই ক্ষেত্রের ব্যর্থতা আংশিক হলেও তা এক কঠিন বাস্তবতার ফল।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে চিত্র অনেক ইতিবাচক। শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পূর্ণ ব্যাংকিং ধস এড়ানো গেছে—এটি সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য। টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল, মূল্যস্ফীতি কমছে, এবং আন্তর্জাতিক আস্থা কিছুটা ফিরেছে।
কূটনীতির ক্ষেত্রেও সরকার ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন শক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শুধুমাত্র ভারত এখনো দূরত্ব বজায় রাখলেও, দিল্লিতেও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, রাষ্ট্র পরিচালনার দিক থেকে সরকারের পারফরম্যান্স “সন্তোষজনক” পর্যায়ের।
২. বিচার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে
জুলাই হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার সরকারের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল। আহত ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনে কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে, তবে কাঙ্ক্ষিত গতি এখনো অর্জিত হয়নি।
জাতিসংঘের অংশগ্রহণে তদন্ত কমিশন কাজ করছে, কিছু মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে—এটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিক ও সুযোগসন্ধানীদের দ্বারা মিথ্যা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মামলার প্রবণতা সরকার এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিচারের সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত, যদিও অনেকেই আশাবাদী যে ন্যায়বিচারের হাত একদিন তাদের ছুঁবে। তবে বাস্তববাদীরা মনে করেন, পতিত স্বৈরশাসকদের বিচারের নজির বিশ্বজুড়েই দুর্লভ।
অতএব, ন্যায়বিচারের পথে সরকার কিছু অগ্রগতি করেছে, কিন্তু পথটি এখনো অসম্পূর্ণ ও কণ্টকাকীর্ণ।
৩. সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা
এ ক্ষেত্রেই সরকারের পারফরম্যান্স সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ২০২৪ সালের শরতে ঘোষিত সংস্কার রোডম্যাপ অনুযায়ী সরকার একাধিক কমিশন গঠন করে—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শ্রম, স্বাস্থ্য, নারী ও পরিবেশ বিষয়ে। এই কমিশনগুলোর প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে “জুলাই সনদ”-এ একীভূত করা হচ্ছে, যা সব দলই স্বাক্ষর করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সংস্কারগুলো বাংলাদেশকে কোনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান আদর্শ রাষ্ট্রে রূপান্তর না করলেও, বাস্তব রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা উন্নয়নে বাস্তবসম্মত রূপরেখা তৈরি করেছে।
৪. রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও উত্তরণের রাজনীতি
এখানেই সরকারের সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ছিল; তাদের একমাত্র কাজ ছিল নির্বাচন আয়োজন। কিন্তু ইউনুস সরকার নিজেকে “জনগণের আন্দোলন-উত্পন্ন রাজনৈতিক সরকার” হিসেবে উপস্থাপন করেছে, ফলে তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করছে। এই রাজনৈতিক প্রকৃতিই সরকারের সবচেয়ে বড় বোঝা। বিভিন্ন গোষ্ঠী—ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (NCP), বিএনপি, জামায়াত, সামরিক আমলাতন্ত্র ও নাগরিক সমাজের নানা ধারা—নিজ নিজ স্বার্থে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। ফলে একদিকে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ায় জনগণের অস্থিরতা বেড়েছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক অদক্ষতা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েনও এরই ফল।
তবু সরকারের একটি গুণ তাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা থেকে রক্ষা করেছে—এটি “শোনে এবং সংশোধন করে”। এই শ্রবণশীলতা ও আত্মসমালোচনার মনোভাবই সরকারকে পুনরায় জনগণের আস্থার দিকে ফিরিয়ে আনছে। রমজানের আগেই নির্বাচনের ঘোষণা এই আত্মসমালোচনার বাস্তব প্রতিফলন।
পর্যালোচনায় দেখা যায়—
- রাষ্ট্র পরিচালনায়: সফল
- ন্যায়বিচারে: সীমিত অগ্রগতি
- সংস্কারে: উল্লেখযোগ্য সাফল্য
- রাজনীতিতে: দুর্বল কিন্তু সংশোধনশীল
অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিখুঁত নয়, তবে বাংলাদেশকে পুনরায় গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছে।
এখন প্রশ্ন শুধু একটাই—এই রাস্তায় তারা কতদূর যেতে পারবে, এবং আসন্ন নির্বাচনে দেশ কি সত্যিই নতুন গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়ের সাক্ষী হবে?
Comments